Sunday, May 10, 2015

রাতের গাড়োয়ান

আজ থেকে আনুমানিক পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তৎকালীন বগুড়া জেলার জয়পুরহাটের একটি ঘটনা। সেটি বর্তমানে জয়পুরহাট জেলার বুম্বু গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে বাস করত এক গাড়োয়ান। তার নাম ছিল মোহাম্মদ মোস্তফা। লোকে তাকে মোস্তফা গাড়োয়ান বলেই ডাকত।
মোস্তফা মিয়া গরুর গাড়ি করে এক বাজার থেকে আরেক বাজারে ঘুরে বেড়াত। গাড়ি করে সে আশেপাশের গঞ্জের বাজারগুলোতে চাল, ডাল, ধান, পাট, গমের ব্যবসা পরিচালনা করত। মোস্তফা মিয়া এক বাজার থেকে কিনে অন্য বাজারে নিয়ে সেগুলো বিক্রি করত। ব্যবসা করেই মোস্তফা মিয়ার সংসার চলত। এভাবে মোস্তফা মিয়ার দিন ভালই চলছে।

তখন ছিল বর্ষাকাল। প্রকৃতিতে ভাদ্রমাসের অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তাঘাট কাদাপানিতে ভিজে একাকার। চারিদিকে গুমোট অন্ধকার। বাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে কুনোব্যাঙের ডাক কানে আসছে। হারিকেনের মিটিমিটি আলোতে মোস্তফা মিয়া পথ চলছে।
বাতাসের ঝাপটায় হারিকেনটি নিভু নিভু করছে। সব মিয়ে ভয়ংকর একটা পরিবেশ। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। মোস্তফা মিয়া বাজার থেকে ফিরতে অনেক দেরি করে ফেলল। এমনিতেই সে সাহসী মানুষ। কোনো কিছুকেই সে ভয় করে না। জ্বীন ভূতকেও সে ভয় করে না। তবে সে রাতের ঘটনা তার বিশ্বাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেদিন কেনো জানি মোস্তফা মিয়ার বুক ভয়ে উঠানামা করতে লাগল। শরীর জুড়ে যেন কাটা বিঁধতে লাগল। অনেক খারাপ কথা তার মনে পড়ে গেল।
এক সময় তার গরুর গাড়িটি বাড়ির পাশের মসজিদে এসে থামল। তখন রাত দুইটা। মোস্তফা মিয়ার হাতের ঘড়িটি নষ্ট। মোস্তফা মিয়ার কাছে মনে হল রাত এগারটা কি বারটা। এখানে এসে সে অনেক মানুষ দেখতে পেল। সাধারণত শুক্রবার ছাড়া এত মানুষ একসাথে দেখা যায় না।
মোস্তফা মিয়া গাড়ি থেকে নামল। ভাবল, এশার নামাজটা মসজিদ থেকে পড়ে গেলে মন্দ হয় না। মসজিদে অবস্থানরত মুসল্লীদের সাথে মোস্তফা মিয়া নামাজ পড়ল।
নামাজ শেষে মিলাদ পড়ল। মিলাদ শেষে তবারক বিতরণের সময় যা ঘটল তা মোস্তফা মিয়াকে অবাক না করে পারল না। প্রথমে মিষ্টি বিতরণ করল। মোস্তফা মিয়ার পেটে রাজ্যের ক্ষুধা। তার পেট ক্ষিধায় চোঁচোঁ করছে। মিষ্টি হাতে পেয়ে গপাগপ মুখে তুলে নিল মোস্তফা মিয়া। এরপর বিতরণ করল কয়লা। মোস্তফা মিয়ার ভাগে চারটি কয়লার খন্ড পড়েছে। কয়লার খন্ডগুলো হাতে পেয়ে মোস্তফা মিয়ার কেমন জানি মনে হতে লাগল। সে দেখলো উপস্থিত সবাই মটমট করে কয়লা খাচ্ছে। মোস্তফা মিয়া ভাবল, মানুষ কি সব ভূত হয়ে গেল নাকি যে কয়লা খাচ্ছে। পরক্ষণেই আবার মনে পড়ল। সে কুরআন শরীফে জ্বীন জাতির কাহিনী পড়েছে।
জ্বীন জাতির লোকেরা খাদ্য হিসেবে মিষ্টি, কয়লা, গোবর ও হাড় খেয়ে থাকে। এসব কথা মনে হতেই মোস্তফা মিয়ার গা চমচম করতে লাগল। সে আবার ভাবল, তাহলে কি আমি জ্বীনের রাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছি।
মোস্তফা মিয়া দ্রুত মসজিদ থেকে বের হয়ে গেল। বের হতেই গ্রামের মুরব্বী ইব্রাহিম চাচা পেছন থেকে ডাক দিল। মোস্তফা মিয়া জানে পিছন থেকে ডাকা মানে অনুক্ষণে। একথা মনে হতেই মোস্তফা মিয়ার শরীর কাঁপতে লাগল।
-এই মোস্তফা মিয়া কই যাইতাছো?
-জি মানে বাড়ি চলে যাইতাছি।
-তই একা একা যাইতে পারবা তো?
-জি পারমু চাচা।
-না তোমারে একা একা ছাড়ন কিছুতেই ঠিক হইব না। একথা বলে ইব্রাহিম চাচা মতলব আর মোখলেছকে মোস্তফা মিয়ার সাথে পাঠালো।
মতলব আর মোখলেছ মোস্তফা মিয়ার গাড়ির আগে হাঁটতে লাগল। তারা দু’জন মোস্তফা মিয়ার সাথে ব্যবসাপাতি নিয়ে আলোচনা করছে। মোস্তফা মিয়া প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করল।
-যা আকাল পড়েছে দেশে বুঝলেন মতলব ভাই। বাজারে এতগুলো মানুষের সামনে একজন মানুষকে মাইরা পালাইল। ভয়ে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। ঘটনার পর লোকজন বলাবলি করছে তারা নাকি ক্ষমতাশীন বাকের ভাই গ্রুপের লোক।
আমরা কি এখনো স্বাধীন? মোস্তফা মিয়া প্রশ্ন ছুঁড়ে মতলব আর মোখলেছের কাছে। কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। এক সময় মোস্তফা মিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে মতলব আর মোখলেছের পা উল্টো দিকে। কথা বলতে বলতে মোস্তফা মিয়ার গরুর গাড়িটি বাড়ির সামনে এসে পৌঁছল। মোস্তফা মিয়া পেছন ফিরে দেখে মতলব আর মোখলেছ নেই। মুহূর্তেই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। সমস্ত ঘটনাটি মোস্তফা মিয়ার কাছে কেমন জানি মনে হতে লাগল। বাড়িতে আসার সময় কয়লার খন্ড চারটি মোস্তফা মিয়া সঙ্গে করে নিয়ে এল। বাড়িতে এসে কুপির আলোয় কয়লার খন্ডগুলোকে আবার সে ভালো করে দেখে নিল। না আসলে এগুলো সত্যি সত্যি কয়লা। একেবারে তাজা তাজা। গরম গরম একটা ভাব এখনো পাওয়া যাচ্ছে। মনে হয় সন্ধ্যার সময় কারো চুলা থেকে আনা হয়েছে। আস্ত কয়লার খন্ডগুলো আর কিইবা কাজে লাগবে।
মোস্তফা মিয়া কয়লার খন্ড কয়টি উঠোনে ফেলে দিল।  সকালে উঠে দেখে কয়লার খন্ড চারটি উঠোনে নেই। মোস্তফা মিয়ার চোখে মুখে একটা কৌতূহল কাজ করতে লাগল। সে রাতের কথা মনে হলে আজো মোস্তফা মিয়ার গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।
daily sangram

1 comment: